দৃশ্যটা কোনো দুর্লভ বিষয়বস্তুর নয়। নয় কোনো নাটক বা চলচ্চিত্রের বিশেষ দৃশ্য। দেখে শুধু বিস্মিতই নয়, মাথার ভেতরে ঝনঝন করে ওঠে। রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর; এখানে রাস্তার দুই ধারে ঝলমল করতে থাকে অভিজাত শৌখিন খাবারের দোকান। এ জায়াগাটাতে সাড়া বছর ভিড় থাকে। সেদিন বিকালেও তাই। নিজের কাজ সেরে রাস্তায় উঠতেই চোখে পড়লো হুইল চেয়ারের দু’পাশে দুটি মগ বেঁধে তার মধ্যে গোলাপ ফুল নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে একটি ছেলে।
দেখে খুব মায়া হল, ভাবলাম কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দেই। অন্তত দুপুরের খাবারটা হয়ে যাবে তার। কাছে গিয়ে কিছু টাকা বের করে দিলাম, কিন্তু কোনোভাবেই টাকা নিতে সে রাজি নয়। কিছু সময় দাঁড়িয়ে খেয়াল করলাম আরও অনেকেই তাকে টাকা দিতে এগিয়ে আসলো, কিন্তু কোনোভাবেই সে টাকা নেয় না!
ছেলেটির পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম একজন মহিলাকে। জিজ্ঞেস করতেই বললো ‘সে তার মা’। ছেলেটির নাম তানভীর হোসেন। বয়স ১৩।
কে কে আছে তানভীরের পরিবারে, কিভাবে চলছে তাদের সংসার? এমন প্রশ্ন মনে উঁকি দিল! উত্তর খুঁজতেই তানভীরের মা বললেন, ‘আমার দুই ছেলে মেয়ে আর আমি। আমাদের তিনজনের সংসার। আমার জামাই অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সংসার চলে আমাদের দু‘জনের আয় থেকে।’
‘আমি ফুটপাতে পান, সিগারেট বিক্রি করি। আর ও ফুল বিক্রি করে। তাছাড়া ও তো একা কিছু করতে পারে না। ওর খাওয়া, বাথরুমে নিয়ে যাওয়া সবতো আমাকে করতে হয়। তাই ওকে চোখের বাইরে যেতে দেই না।’
তানভীরের মা বলেন, ‘আমার একটাই স্বপ্ন ছেলে যেন নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারে। সিআরপি চিকিৎসকরা বলেছেন ৭৫ হাজার টাকা লাগবে। এবং তিন মাস হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে।’
ধানমন্ডি ৩২, শেখ মজিবুর রহমানের বাড়ির সামনে অনেক মানুষই তানভীর ও তার মাকে চেনে। সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের ভাষ্য, তানভীরকে কেউ কোন দিন অসহায় ভেবে কোন টাকা দান করতে পারেনি।
এ ব্যাপারে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সার্জেন্ট রফিক ইসলাম বলেন, ‘অনেক মাস ধরেই আমি এই ছেলেকে দেখে আসছি। সিগন্যাল দিলেই ও এক পা ঠেলে ঠেলে মানুষের গাড়ির সামনে যায়। যেন তার কাছ থেকে ফুল নিয়ে তাকে কিছু টাকা দেয়। কিন্তু ফুল না নিলে কারো কাছ থেকে টাকা নিতে দেখিনি। কেউ জোর করে দিতে চাইলেও নেয় না।’
তবে তানভীর হোসেনকে নিয়ে মায়ের অকপট ভাষ্য, ‘আমার ছেলে চিন্তা করে, ফুল না নিলে মানুষ ভাববে আমি ভিক্ষা করি। তাহলে আর আমার কর্মের কোন মূল্য থাকবে না।’
‘একবার এক সাহেব আমার ছেলেকে ৫০০ টাকা দিতে চেয়েছিল কিন্তু সে নেই নাই। বেশ কয়েকবার জোড়ও করেছে, তবুও সে নেই নাই। পড়ে সাহেব রেগে গিয়ে টাকা ফেলে দিয়ে চলে গেছে।’
তানভীরের মা বলেন, ‘আমার ছেলের টাকার প্রতি কোন লোভ নাই, ও ভিক্ষা চায় না। ওর চিন্তা হচ্ছে আমার থেকে সবাই একটা ফুল নেবে, তার বিনিময়ে টাকা নেবো।’
তানভীর শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও মানসিকভাবে দারুণ স্বচ্ছল। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় জোর হচ্ছে মনের জোর- কিশোর তানভীর এই বিশ্বাসটাকে লালন করছে মনে প্রাণে।